আমরা মাদাম কুরি সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞাত নই। তিনি আধুনিক বিজ্ঞান ইতিহাসের একজন দুর্দান্ত পদার্থবিদ, রসায়নবিদ এবং সর্বোপরি বিজ্ঞানী। তিনি এবং তাঁর স্বামী পিয়ের কুরি তেজস্ক্রিয়তার বিষয়ে গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং পরে স্বতন্ত্রভাবে তিনি আবিষ্কার করেন পোলোনিয়াম। এই মৌলের আবিষ্কার এবং পরবর্তীতে রেডিয়ামের আবিষ্কার তাঁকে রসায়নের নোবেল পুরস্কার এনে দেয় । তবে এই পুরস্কারের আগে শ্রীমতী কুরির জীবনের সবচেয়ে বড় এক দাগ ছিল। তিনি তাঁর ছাত্রের সাথে গোপন সম্পর্ক রেখেছিলেন আর এজন্যে নোবেল পুরস্কারটি প্রায় হাতছাড়াই করে ফেলেছিলেন।
1906 সালে, মেরি কুরির স্বামী পিয়ের কুরি একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেরি কুরি অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছিলেন কিন্তু তার পরও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ চালিয়ে যান অবিশ্রান্তভাবে। এ এক সময় ছিল, যখন সমস্ত আবেগ-অনুভূতিকে বিসর্জন দিয়ে তাঁকে বেছে নিতে হয় নিরুত্তাপ এক জীবনচর্যা।
তবে, এখনও এমন একজন ছিলেন যিনি মাদাম কুরির জীবনে প্রবেশ করে তাঁর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত করেছিলেন। এই ব্যক্তি হলেন পল ল্যাঙ্গভিন, একজন শিক্ষার্থী যিনি মাদাম কুরির চেয়ে 5 বছরের ছোট।
স্বামীকে হারানোর পরে, মাদাম কুরি তখন এমন এক অবস্থায় যে তাঁকে কেবল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিমজ্জিত থাকলে হবে না, পাশাপাশি তাঁর দুই কন্যাকেও দেখাশোনা করতে হবে। যাইহোক, ল্যাঙ্গভিন তাঁকে পারিবারিক ও বিজ্ঞানের জগতে যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন, যা তাঁকে ভীষণ উৎসাহিত করেছিল। যারপরনাই, ধীরে ধীরে কুরি ল্যাঙ্গভিনের প্রেমে পড়ে যান সাবলীলভাবেই ।
তবে ল্যাঙ্গভিন তো এক বিবাহিত পুরুষ এবং তাঁর স্ত্রী কমবয়েসী এক মহিলা। তিনি প্রায়শই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ল্যাঙ্গভিনের সাথে ঝগড়া করতেন এবং অভিযোগ আনতেন যে ল্যাঙ্গভিন পরিবারে কোনো অবদানই রাখতে পারেন না আর শুধু নিজের চাহিদাই মেটাতে জানেন, নিজের বিজ্ঞানচর্চার পেছনেই যাবতীয় খরচ করতে জানেন। একজন বিজ্ঞানী আর একজন ঘরোয়া স্ত্রীর কথোপকথনের ভাষা বা বাচনভঙ্গি কোনোদিন মিলতে পারে না। ধীরে ধীরে ল্যাঙ্গভিনও তাই তাঁর স্ত্রীর প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে যেতে লাগলেন । উল্টোদিকে , মিসেস কুরির প্রতি তিনি অনুভব করেছিলেন একপ্রকার মানসিক অনুরণন, যেহেতু তিনিও তাঁর মতোই একজন বিজ্ঞানী।
ফলস্বরূপ, মাদাম কুরি এবং ল্যাঙ্গভিন দুজনেই একে অপরের প্রেমে পড়েন এবং দু'জনে মিলেই ল্যাঙ্গভিনের স্ত্রীর কাছ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ আদায়ের পরিকল্পনা করেন । যাইহোক, ল্যাঙ্গভিনের স্ত্রী রীতিমতো জীবন-মরণ পণ করে হলেও বিবাহ বিচ্ছেদ না ঘটানোর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন এবং অবশেষে ডিভোর্সের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল৷ কিন্তু ঘটেছিল কিছু অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
ল্যাঙ্গভিনের স্ত্রী তাঁর উদ্দেশ্যে লেখা মাদাম কুরির একটি প্রেমপত্র আবিষ্কার করেছিলেন এবং গণমাধ্যমে প্রকাশও করেছিলেন। এরকম একটি ব্রেকিং নিউজ যে মিডিয়ার হাতে পড়ে অতিরঞ্জিত হবে এবং মাদাম কুরির ভালবাসা এবং যৌনতার প্রতি আগ্রহ কুৎসার আকারে প্রকাশ করা হবে, এমনটাই তো প্রত্যাশিত। সবাই মাদাম কুরির সমালোচনা করতে শুরু করলো। এমনকি তাঁকে "পোলিশ বেশ্যা" নামে ডেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে বলতেও দ্বিধাবোধ করা হয়নি। তবে ফ্রান্সের জনগণ সেই সময় হঠাৎ দেখলো, মাদাম কুরি পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম সংক্রান্ত গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসাবে মনোনীত হতে চলেছেন। আয়োজকরা মাদাম কুরির এহেন কেলেঙ্কারির কথা শুনে তাঁর মনোনয়ন বাতিল করতে চেয়েছিলেন। তবে রাষ্ট্রের সহায়তায় মাদাম কুরি অবশেষে মনোনীত হয়েছিলেন এবং রসায়নে নোবেল পুরস্কারের বিজয়ীও ঘোষিত হয়েছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে, লোকের কাছে কুরির কেলেঙ্কারি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার সময় ছিল না, তবে কুরি ব্যক্তিগতভাবে এক্স-রে দ্বারা আহত সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য চলে আসেন প্রথম সারিতে। ১৯৩৪ সালে, মেরি কুরি ম্যালিগন্যান্ট লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে পরলোকগমন করেন। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, গবেষণার কারণে তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা টার্ম এক্সপোজার।
এতকথার মূল সারমর্ম এটাই যে, কোনো মানুষই এমন মহর্ষি বা সাধ্বী নন, যারা চাইলেই যা খুশি করতে পারেন, জীবনকে সম্পূর্ণ কলুষমুক্ত রাখতে পারেন। মাদাম কুরির জীবন বিজ্ঞানকে উৎসর্গ করা হয়েছে। তিনি আজও আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়, এক মহান বিজ্ঞানী।
Thanks for reading: মাদাম ক্যুরির গোপন প্রেম ও পরকীয়তা | Madame Curie's secret love and alienation, Sorry, my English is bad:)